মহান শিল্পী মান্না দে’র জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

ক’জনা তোমার মতো গাইতে জানে

প্রকাশ: মে ১, ২০২৪ ১১:২০ am , আপডেট: মে ১, ২০২৪ ১১:২১ am

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


মান্না দে, জন্ম মে ১ , ১৯১৯ , মুত্যু : ২৪অক্টোবর ২০১৩

অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন

সঙ্গীতের মানচিত্রে যুগে যুগে কালে কালে বহু শিল্পীর আবির্ভাব হয়। আবার কালের নিয়মে তাঁরা চলেও যান একসময়ে। কিন্তুু কিছু কিছু শিল্পী কখনো এমনও আসেন, যাঁদের গান সারা জীবন ধরে মনের কোণে চিরস্থায়ী আসন করে নেয়। আর এই অনুভুতিই যখন পৃথিবীর কোণে কোণে বহু মানুষের হৃদয়ে জেগে উঠে, তখন ভালবাসার সেই শিল্পীই হয়ে উঠেন কালজয়ী।মান্নাদের মতোন শিল্পীর সাঙ্গীতিক মুল্যায়ন করার মত ধৃষ্টতা আমার নেই।বাংলা তথা উপমহাদেশের অসংখ্য গুনমুগ্ধ শ্রোতার মধ্যে আমিও একজন।তাই তার ভালবাসার রাজপ্রাসাদের একজন গুনমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে না লিখে পারলাম না। পারলাম না একারনে যে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ইতিহাসে তার কালজয়ী গান “মানবোনা এই বন্ধনে মানবোনা এই শৃঙ্খলের” এই সব গান গেয়ে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।
এমন একটা সময় ছিল মানুষ অপেক্ষা করতো পুজোর গানের জন্য। এখনকার মতো হাজার হাজার শিল্পীর ভীড় তখন ছিলোনা।আমরা তাকিয়ে থাকতাম গুটিকয়েক ‘‘শারদ অর্ঘ্য’ বই আর গুটি কয়েক রেকর্ড এর জন্য।আর তখনকার দিনে গ্রামোফোন মেশিন, রেকর্ড প্লেয়ার কেনার সামর্থ্য সবার ছিলোনা।মা একটি পিলিপস রেডিও পরিবারের জন্য কিনে দিয়েছিলেন।ওটাই সম্বল।আকাশবানী থেকে মাঝে মধ্যে ভেসে আসতো মান্না দের গাওয়া অদ্ভুত সুন্দর গান “তুমি আর ডেকোনা পিছু ডেকোনা। সত্যি বলছি গান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কি রকম যেন ঘোর কাটেনা। গান বাজতে থাকলো “এই তো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে আমার অবুঝ বেদনা”। জানলাম শিল্পীর নাম মান্না দে। গান আমি ছোট বেলা থেকেই গাইতাম।শিখতাম ককবাজারের একমাত্র ওস্তাদ স.ম. আবুবক্কর সিদ্দিকীর কাছে। নিয়মিত রেওয়াজ চলতো।তখন সঙ্গীতের ছাত্র হিসেবে সুরের আনাগোনা , সুরের অলংকার – বিন্যাস এগুলোই আমাকে আকর্ষন করতো বিশেষভাবে। গান শুনলে সুরটা যেন কিভাবে মনে থেকে যেতো।আরো লক্ষ্য করলাম শুধু সুর নয়, কথাগুলোও মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে।শিল্পী যেন কি এক যাদু বলে গানের কথাগুলি সুরের সাথে আমার মনে গেঁথে দিয়েছেন।আমার কিশোর মনের কোণে ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ একমাত্র মান্নাদেই তৈরী করে দিয়েছেন।
আমি ধীরে ধীরে বোধের একধাপ উপরে উন্নীত হলাম। গান মানে কি? গান কি শুধু সুর? শুধু কথা? নাকি অব্যক্ত অন্য কোন কিছু?উত্তর খুজতে লাগলাম মনে মনে।আর শুনতে লাগলাম মান্নাদের গাওয়া আরো কিছু গান “সেই তো আবার কাছে এলে এতো দিন দুরে থেকে বলোনা কি সুখ তুমি পেলে” এই লাইনটি আমি অনেকবার সুর ছাড়া বলে দেখেছি। আমি দেখেছি গানের এই কথাগুলোই যেন সুর হয়ে উঠে আমার কাছে।
আামি একটু একটু বড়ো হয়ে উঠেছি। স্কুলের পরিধি ছেড়ে কলেজে চলে এসেছি। আমার ওস্তাদজী স.ম আবুবক্কর চৌধূরীর কাছে তাল লয় ছন্দে ডুবে থাকার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গান শোনার, বোঝার, বিশ্লেষন করার ও গাইবার অভ্যাস শুরু গয়ে গেছে তখন থেকেই।তাঁর গাওয়া কালজয়ী গান “কফি হাওসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই” গানটি আমি চুপিসারে ওস্তাদজীর অজ্ঞাতসারে নিজে নিজে শিখেছি। এটি ককসবাজারে আমার গাওয়া মান্না দের প্রথম গান।তিনি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন কিছুদিন হল। এখন এই গানতো ইতিহাস হয়ে গেছে। এর পর তিনি স্বপ্নের কফি হাউস কে নিয়ে আরো একটি গান গেয়েছেন।আধুনিক গানে প্রেমের সম্রাট ধরা হয় তাঁকে। এর বাইরেও তিনি অনেক গান গেয়েছেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সলিল চৌধুরীর লেখা সুরে মান্না ও সবিতা চৌধুরীর গাওয়া “এই দেশ এই দেশ এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত“ আমার সোনার বাংলা ”রেডিওতে এতই জনপ্রিয় হয়ে যায়যে, জাতীয় সঙ্গীতের মতো মনে হতো। মান্না দের অনুষ্ঠান বলতেই রাগাশ্রিত কিছু গান থাকবেই। তাঁর বেশীর ভাগ গানই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিবদ্ধ।একটা অনুষ্ঠানে তিনি বলেই ফেললেন তার সব গান তিনি তাঁর স্ত্রীর জন্যই গেয়েছেন।মৃত্যু শয্যায় তিনি তাঁর কাকাবাবুর গান “ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি” এই গানটিই শুনতে চাইতেন।ঐ গানটি কোন ফাংশানে গাইলে তিনি চোখের জলে ভাসতেন। মান্নাদের প্রেমের পুরানো গান – যে গানের প্রথম শ্রোতা ছিলেন তাঁর স্ত্রী।
একবার, পুজোর আগে সিন্ধি খনি অঞ্চলে একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন মান্না দে। সে বার সঙ্গে ছিলেন পুলকবাবুও। সেই এলাকায় তাঁর ভায়রা-ভাই গৌরীসাধন থাকতনে। কিন্তু কিছুতেই তাঁর বাড়ি খুঁজে পাচ্ছনে না। মান্নাদেকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে বাড়ি খুঁজতে গেলেন পুলক। একটু পরে ফিরলেন হাসতে হাসতে বললনে,‘‘মান্নাদা, আপনার পুজোর গান তৈরী হয়ে গেছে’’।
মান্নাদে তো খুব অবাক! পুলক গাড়িতে বসতেই তিনি বললেন, ‘‘সে কী মশাই? আমি তো এখান থেকেই দেখতে পেলাম ম আপনি ওই বাড়িতে গেলেন কলিং বেল টিপলেন, কে যেনো দরজা খুলে আপনাকে কী বলল আর আপনওি দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। এর মধ্যে গান তৈরী হল কী করে?’’
পুলক হাসতে হাসতে বললনে, ‘‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেনো? বলছি তো নতুন গান তৈরী হয়ে গেছে।“
বাক্যটি পুলক-মান্নার স্মৃত-লিখা থেকেসে দিন একটা ভুল বাড়ীর দরজার কলিংবেল বাজিয়েছিলেন পুলক। বেলের শব্দে এক ‘অসাধারণ’ সুন্দরী দরজা খুলে ভুল ভাঙ্গিয়ে দেন। কিন্তু ততক্ষণে পুলক পেয়ে গিয়েছিলেন মান্নার জন্য তাঁর গানরে মুখড়া। লিখে ফেল্রন, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো? এমনি করে ফিরে তাকালো! দেখেতো আমি আমি মুগ্ধ হবই! আমি তো মানুষ!’
এমন ভাবেই সুন্দরী বিমান সেবিকাকে দেখে প্লেনের উেইন্ডো সিটে বসে ন্যাপকিনে লিখেছিলেন, ‘ও চাঁদ, সামলে রাখো জোছনাকে।”
ঝলকানো রাতের পার্টিতে লাজুক সুন্দরীর কান থেকে পড়ে যাওয়া ঝুমকো কুড়িয়ে ফেরত দিতে দিতে লিখেছেলেন মান্নার গান, ‘জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি খসে পড়ছে’’ এ সব গানের কথা, আজও বাঙালি শ্রোতার র্মমে গাঁথা।
উত্তর কলকাতার মদন ঘোষ লেনে মান্না দে অর্থাত প্রবোদ চন্দ্র দে জন্ম।পিতা পুর্ণচন্দ্র দে এবং মা মহামায়া দেবী। পরিবারে মেজকাকার কথাই ছিল শেষ কথা তিনি চেয়েছিলেন তাঁর দাদার মেঝছেলেটি ওকালতি নিয়ে পড়াশোনা করুক। কিন্তু প্রবোদ চন্দ্র ওরফে মান্না দে চেয়েছিলেন সঙ্গীতকে নিয়ে বড়ো হতে।অনেক কস্টে মেজকাকাকে রাজি করা গিয়েছিল।কাকা কৃষন চন্দ্র দে র সহকারী হিসেবে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন।তিনি স্কটিশ চার্চ কলেঝিয়েট স্কুল এবং অধ্যয়নকালীন তার সহপাঠীদের গান শুনিয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন।তাঁর প্রথম কন্ঠ রেকর্ড হয়েছিল “রামরাজ্য ” ছবিতে। ওস্তাদ দবীর খাঁ সাহেবের কাছে তিনি সঙ্গীতে তালিম নিয়েছিলেন ।হিন্দি, বাংলা মারাঠি গুজরাটিসহ অজস্য ভাষায় তিনি ষাট বছরেরও অধিক সময় সঙ্গীত চর্চা করেছিলেন। বৈচিত্রের বিচারে কাঁকেই হিন্দি গানের ভুবনে সর্বকালের সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকার করে থাকেন অনেক বিশেষজ্ঞ সঙ্গীত বোদ্ধারা।সঙ্গীত জীবনে তিনি সাড়ে তিন হাজারেরও বেশী গান রেকর্ড করেন। সঙ্গীত ভুবনে তার এ অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করে ভারত সরকার ১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী ২০০৫ সালে পদ্মভুষণ এবং ২০০৭ সালে তাঁকে “দাদা সাহেব ফালকে” সম্মাননায় অভিষিক্ত করেন।২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রাজ্যের সর্ব্বোচ্চ অসামরিক সম্মান “বঙ্গবিভুষণ” প্রদান করে।সুদীর্ঘ ৯৪ বছর কৈশোর থেকে আমৃত্যু মান্নাদে একটি জিনিসের সঙ্গেই অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে ছিলেন। সেটি হলো সঙ্গীত।
শেষ ছয় মাস হাসপাতালে থাকার সময় বেশী কথা বলতে পারেননি মান্না দে। বড় কস্টের সব দিন। তাঁর মৃত্যু শয্যায় আপনজন বলতে কেউ ছিলনা পাশে।মৃত্যু শয্যায় তিনি দুটো কথা সব সময় বলতেন,“ আমি তো কারো ক্ষতি করিনি । গান গেয়ে আনন্দ দিতে চেয়েছি। তাহলে আমি এতো কস্ট পাচ্ছি কেন? মান্নাদে আসলে আকাশের মতো উদার , নতুন। আকাশ কখনো পুরানো হয়না। প্রতিদিন নতুন ।মান্নার গানের সোনালী বিকেলগুলো চিরকাল ভরে থাকবে।